ইসলামী বিশ্বকোষে আব্দুল হাই সিদ্দিকী
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য ২৫ খন্ডে প্রায় ২০,০০০ (বিশ হাজার) পৃষ্ঠার বিস্তারিত ইসলামী বিশ্বকোষ প্রণয়ন করেছে। কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শত শত আলেম নিরলসভাবে কাজ করেছেন।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও সমাদৃত এই বিশ্বকোষের প্রথম খন্ডে ফুরফুরার হযরত বড় হুজুর আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.) এর উপর একটি মূল্যবান, তথ্য বহুল ও সারগর্ভ নিবন্ধ সংযোজিত হয়েছে। ইসলামী বিশ্বকোষ ১ম খণ্ডে ৫১৯-৫২০ পৃষ্ঠা থেকে উক্ত নিবন্ধটি এখানে হুবহু তুলে ধরছি।
আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.)
মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল হাই, কুনিয়াত আবু নসর, বংশীয় উপাধী সিদ্দিকী।
উপমহাদেশের একজন মুহাককিক আলেম, বিখ্যাত ওয়াইজ, সমাজ সংস্কারক, হাক্কানী পীর ও সুফি; উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁহার বিশেষ অবদান ছিল। ১৩২৩/ ১৯০৩ পৌষ ১৩১০ বঙ্গাব্দে তিনি ভারতের পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলার ফুরফুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম মাওলানা শাহ সুফি আবু বাকর সিদ্দিকী (রহ.) যিনি আমীরুশ শারীআত ও মুজাদ্দিদ-ই যামান বলিয়া খ্যাত। তাঁহার মাতা নেজিয়া খাতুনও বিদূষী মহিলা ছিলেন। কথিত আছে যে, পিতা ও মাতা উভয়েরই বংশীয় নিসবাত ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এর সহিত রহিয়াছে। সেই কারণে তাঁহারা সিদ্দিকী উপাধি ধারণ করিয়া আসিতেছেন। আব্দুল হাই পিতার জেষ্ঠ্য পুত্র। তাঁহার লেখাপড়া শুরু হয় গৃহে মাতার কাছে। ৬ বৎসর বয়সে তাঁহাকে ফুরফুরা মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। এখান হইতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তাহাকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি করিয়া দেওয়া হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া তিনি পিতার সান্নিধ্যে থাকিয়া ইলম-ই জাহির ও ইলম-ই বাতিন এর উপর প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বাংলা ১৩৩০ সনে তিনি পিতার সহিত হজ্জ ও যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মক্কা মুআজজামা ও মদীনা মুনাওয়ারায় যান। দেশে প্রত্যাবর্তন করিয়া তিনি পিতার সহিত বাংলা ও আসামের বিভিন্ন স্থানে যাইয়া ইসলাম প্রচার করিতে থাকেন। দীনী জলসা ও মাহফিলে পিতার সহিত যোগদান করিয়া তিনি লক্ষ মানুষের সামনে ওয়াজ-নাসীহাত করিতেন। কুরআন হাদীস, ফিকহ, আকাইদ, মানতিক, ফালসাফা, ইতিহাস এবং কাব্য সাহিত্যে তিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ফারসী এবং উর্দূ কাব্যেও তাঁহার দখল ছিল।
তাঁহার পিতার ইন্তিকালে (২৫শে মুহাররাম ১৩৪৫/১৭ই মার্চ ১৯৩৯) তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং পিতার আরদ্ধ কার্যাবলী সম্পন্ন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পিতার ন্যায় তিনিও শিরক, বিদআত ও কুফরীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। সমাজে বিরাজিত যাবতীয় অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার ও ইসলাম বিরোধী আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন। খৃষ্টান মিশনারীদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধেও তিনি রুখিয়া দাঁড়ান।
তাঁহার পিতার ইন্তেকালে আঞ্জুমানে ওয়ায়েজীন ও জমিয়তে ওলামায়ে বাংলার সভাপতির দায়িত্ব তাঁহার উপর অর্পিত হয়। এই সময় যশোর, নদীয়া, দিনাজপুর বগুড়া প্রভৃতি অঞ্চলে খৃষ্টান মহিলা মিশনারীরা পলদীতে যাইয়া সরলমনা মুসলিম মহিলাদেরকে খৃষ্টান বানাইবার চেষ্টা করিতেছিল। তিনি আঞ্জুমানে ওয়ায়েজনি এর সদস্যগণ এ সমস্ত অঞ্চলে প্রেরণ করেন। ফলে খৃষ্টান মিশনারীদের এ প্রচেষ্টা অনেকটা ব্যর্থ হয়। তাঁহার নেতৃত্বে জমিয়ত ওলামা ভারতে মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। তদান্তীন নিখিল বাংলা ও আসামে তাঁহার নেতৃত্বে জমিয়তে ওলামা শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। জমিয়তে ওলামায়ে বাংলার লক্ষ্য ছিল শারী আতী সমাজ গঠন ও স্বাধীনতা অর্জন। ১৯৪৬ খৃষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, পশ্চিম বাংলা, আসাম ও পূর্ববংগ (বর্তমান বাংলাদেশ) হইতে পাকিস্তান সমর্থনকারীদের সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন লাভের পশ্চাতে তাঁহার অশেষ অবদান ছিল।
তিনি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ঃ জমিয়তে ওলাময়ে হানাফীয়া, সিদ্দিকীয়া নূরুল ইসলাম বায়তুল মাল, হিযবুল্লাহ প্রভৃতি। মানবজাতির কল্যাণে তিনি নিবেদিত ছিলেন। তাই তিনি ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে খেদমতে খালক ও ইশাআতে ইসলামের জন্য শেষোক্ত সংগঠন বিশ্ব ইসলামে মিশন কুরআন কুরআনী সুন্নীজমতুল ঈয়তুল মুসলিমীন হিযবুল্লাহ গঠন করেন। লিখনী, বক্তৃতা, পত্রিকা প্রকাশ, গবেষণা ও মানব সেবার মাধ্যমে সুন্দর ব্যবহার ও হিকমাতের সহিত মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করাই এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
তিনি বাংলা ভাষায় পত্র পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগও গ্রহণ করেন। আশ্বিন ১৩৫০/ রামদান ১৯৬২ সালে তাঁহার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কলকাতা হইতে নেদায়ে ইসলাম নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অদ্যাবধি কলকাতা ও ঢাকা হইতে পৃথক পৃথক ভাবে এই মাসিক পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হইতেছে। ১৯৭৯ খৃষ্টাব্দে ঢাকা হইতে তাঁহার নির্দেশে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক মানবতা। তাঁহার রচিত বহু প্রবন্ধ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহার নির্দেশে ও তত্বাবধানে প্রচুর ইসলামী পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছে। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। নারীশিক্ষার প্রতি তিনি অত্যাধিক জোর দিতেন। তিনি বলিতেন, কেবল মাত্র পুরুষ শিক্ষা ও প্রগতির দ্বারা সমাজের জাগরণ আসে না। নারী জাতিরও শিক্ষা সংস্কারের বিশেষ প্রয়োজন। [সিরাজুল ইসলাম হযরত মওলানা আবদুল হাই সিদ্দিকী (রহ.) এর জীবন ও বাণী পৃ .৩১]।
তাঁহার পৃষ্ঠপোকতায় ফুরফুরার অদূরে অবস্থিত চকতাজপুর নামক স্থানে পশ্চিম বংগ সিদ্দীকা গার্লস হাই মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদরাসার ছাত্রীদে জন্য ইহার সংলগ্ন ছাত্রীবাসও নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে ভারত বিভক্তির পর ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র কলকাতা আলিয়া মাদরাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হইলে পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা ইসলামী শিক্ষা গ্রহণে এক সংকটের সম্মুখীন হয়। তাঁহার প্রচেষ্টায় ভারত সরকার পুনরায় কলকাতা আলিয়া মাদরাসা চালু করেন। পুনরায় মাদ্রাসা বোর্ড ও মাদ্রাসাসুমুহ সরকারী নিয়ন্ত্রণে আসে। (দ্র..কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্র পরিচিত, ১৯৭১)।
মাওলানা আদুল হাই সিদ্দিকী পশ্চিম বংগ, আসাম, বিহার ও বাংলাদেশ-এর লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্তরকে ইলম-ই তাসাওউফ-এর শিক্ষা দ্বারা উদ্ভাসিত করিয়াছেন। তাঁহার মুরীদের সংখ্যা অসংখ্য। ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও তাঁহার ভক্ত ও মুরিদ আছে। তিনি মুরিদগণকে কাদিরিয়া, নাকশাবন্দীয়া, মুজাদ্দেদিয়া ও মুহাম্মাদীয়া তারীকার সবক দিতেন।
বিভিন্ন স্থানে তিনি খানকাহ্ স্থাপন করেন। পাবনা জেলার পাকশীতে স্থাপন করেন, একশত স্তম্ভ বিশিষ্ট একটি খানকাহ। ইহার নাম রিয়াযুল জান্নাত। ঢাকার মীরপুর এলাকায় অবস্থিত দারুস্সালামেও তিনি একটি খানকাহ স্থাপন করেন। এই খানকাহতে প্রতি বৎসর ইসালে ছাওয়াব-এর মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ওয়াইজ ছিলেন। তাঁহার ওয়াজ শুনিবার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড় জমিত। সকল শ্রেণীর মানুষের অন্তরে তাঁহার ওয়াজ এমনভাবে রেখাপাত করিত যে, শ্রবণকারীর অনেকেই সত্যিকারের ইসলামী যিন্দিগীতে ফিরিয়া আসে। আজীবন তিনি দীন ইসলামের বাণী পৌঁছাইবার উদ্দেশ্যে নিরলসভাবে ভারতের নানা জায়গায় এবং বাংলাদেশের গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ওয়াজ নাসীহাত করিয়া মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করিয়াছেন। তিনি তাঁহার অধিকাংশ সভাতেই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে বক্তব্য রাখিতেন। রাজনীতিও বাদ যাইত না। তিনি বলিতেন: স্বাধীনতা ও মানবতা দুইটি কথা। যেখানে স্বাধীনতা নাই, সেখানে মানবতা নাই। আর মানবতাহীন স্বাধীনতা মুল্যহীন (দ্র. মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম, হযরত মাওলানা আব্দুল-হাই সিদ্দিকী (রহ.) এর জীবন ও বাণী, পৃঃ ১৩৭, কলকাতা, মার্চ ১৯৮৩) তিনি অত্যন্ত সাদাসিধা জীবন যাপন করিতেন। তিনি ১৯৬৭ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার হজ্জ পালন করেন। ১৯৭৭ খৃষ্টাব্দের ১২ই মে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হইয়া তিনি কলকাতার সেন্ট মারিস নার্সিং হোমে ভর্তি হন এবং ২৪শে জুমাদা’ল-আওওয়াল ১৩৯৭/ ১৩ই মে ১৯৭৭ /৩০ শে বৈশাখ ১৩৮৪ শুক্রবার দিবাগত রাতে ১১ ঘটিয়ায় উক্ত নার্সিং হোমেই ইন্তেকাল করেন। ১৪ই মে রবিবার অপরােহ্ন তাঁহাকে ফুরফুরা গ্রামে তাঁহার পিতার কবরের পাশে দাফন করা হয়।