ফুরফুরার ইতিহাস

মুসলিম বিজয়ের পূর্বে

হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে ফুরফুরা এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীনে আসে। মুসলিম বিজয়ের পূর্বে এ অঞ্চল বালিয়া-বাসন্তী নামে অভিহিত হত এবং একজন হিন্দু ভূস্বামী বা বাগ্দী রাজার অধীন ছিল। যদিও তখন বঙ্গদেশের শাসনকর্তা মুসলমান ছিলেন, তথাপি তিনি সম্পূর্ণরূপে সমস্ত বঙ্গদেশকে করায়ত্ত করতে পারেননি।

কথিত আছে যে স্থানে উক্ত ভূস্বামীর বাস ছিল তা বাগ্দী রাজার গড় নামে অভিহিত হত। বর্তমানে উক্ত স্থানটি চার-শহীদের গড় নামে খ্যাত। উক্ত ভূস্বামীর নাম ইতিহাস পুস্তকে পাওয়া যায় না। তবে তাঁর বাড়ির সম্মুখে চন্দ্রপুকুর নামে একটি পুকুর ছিল, তা থেকে অনুমান হয় রাজার নাম চন্দ্রনাথ কিংবা চন্দ্রমোহন ছিল। পার্শ্ববর্তী স্থানের নাম গোবিন্দপুর থাকায় অনেকের ধারণা রাজার নাম গোবিন্দচন্দ্র। সেকালে বালিয়া-বাসন্তীর প্রায় সকলেই হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিলেন। তখন সেখানে কোন মুসলমানের বসতি ছিল কিনা তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। দু এক ঘর মুসলমান থাকার কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, যদিও এ তথ্য নিশ্চিত নয়।বালিয়া-বাসন্তী বিজয়ের শত বছর পূর্ব থেকে বঙ্গের বিভিন্ন নগর মুসলমান সুলতান কর্তৃক বিজিত হয়। একাধিক রাজ্য জয় করে বঙ্গে মুসলিম সুলতানাত কায়েম করলেও সম্পূর্ণ বঙ্গের উপর তাদের কর্তৃত্ব ছিল না। ফলে, বিভিন্ন রাজ্যে কতিপয় অমুসলিম নরপতির আমলে সংখ্যালঘুদের উপর অমানুষিক জুলুম ও অবিচার চলতে থাকে। সে সব অত্যাচারের নির্মম কাহিনী সুলতানদের কর্ণগোচর হতে থাকে। ফলে সুলতান কর্তৃক মনোনীত সেনাপতিরা বিভিন্ন রাজ্য আক্রমণ করে মুসলিম সুলতানাত কায়েম করেন।

বাগদী রাজার অত্যাচার

হুগলী জেলার জাঙ্গীপাড়া থানার বালিয়া পরগনার অধীন বালিয়া-বাসন্তীর তৎকালীন হিন্দু ভূস্বামী বাগ্দী রাজা অত্যন্ত সংকীর্ণমনা ও অত্যাচারী ছিলেন। উক্ত রাজ্যের অধিকাংশ অধিবাসী তখন গরীব, অশিক্ষিত ও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ছিল।

আইন-শৃঙ্খলার চরম অবণতি ঘটায় দস্যু-তসকরদের দৌরাত্ম্যে নৈরাজ্যের কালো ছায়া রাজ্যের জন-মানসে সর্বত্র বিরাজ করতে থাকে। রাজার অপশাসনে প্রজারা দুর্বিষহ অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে থাকে। কর আদায়ের অজুহাতে জুলুম, বিচার-আচারের নামে অবিচার-অনাচার, স্বজন-পোষণ, জাতিভেদ, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ও অসহিষ্ণু মনোভাবের নির্মম কাহিনী সুলতানের কর্ণগোচর হয়।

হুগলী জেলার পান্ডূয়া পরগনায় পান্ডূয়া রাজার অনুরূপ অত্যাচারেআর রোমাঞ্চকর কাহিনীও সুলতান অবগত হন।

মুসলিম অভিযান

হযরত শফিউদ্দীন শহীদ ওরফে শাহ সুফি সুলতান (রহ.) তখন পান্ডূয়ায় বসবাস করতেন। বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী জাফর খান গাজীর অধীনে বিরাট একদল সৈন্য বাংলা অভিযানে প্রেরণ করেন। ঐ দলে হযরত শাহ্ সুফী সুলতান ও হযরত সৈয়দ হোসেন বুখারী (রহ.) প্রমুখ উচ্চশ্রেণীর বুজুর্গ ব্যক্তিগণও প্রেরিত হন।

হযরত শাহ সুফি সুলতান ছিলেন হযরত শরফুদ্দীন বু-আলী কলন্দরের স্নেহভাজন খলিফা। সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী হযরত বু-আলী কলন্দরের খুবই ভক্ত ছিলেন।
হযরত শাহ সুফি সুলতান (রহ.)-এর পরামর্শক্রমে উক্ত প্রেরিত সৈন্যদল দুভাগে বিভক্ত হয়ে হযরত শফিউদ্দীন ওরফে শাহ সুফি সুলতানের নেতৃত্বে জা’ফর খান গাজীসহ পান্ডূয়া অভিযান করেন। এ অভিযানে পান্ডূয়া রাজার সঙ্গে যুদ্ধে হযরত শাহ্ সুফি সুলতান (রহ.) শহীদ (৬৯৫ হিজরী) হন এবং পান্ডূয়া বিজিত হয়। তার তিন বছর পর (৬৯৮ হিজরী মোতাবেক ১২৯৮ খৃস্টাব্দে) জাফর খান গাজী সপ্তগ্রাম জয় করেন। হযরত শাহ সুফি সুলতান (রহ.) এর আদেশে হযরত সৈয়দ হোসেন বুখারী (রহ.)-র নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বালিয়া-বাসন্তী অভিমুখে গমনপূর্বক বাগদী রাজার রাজবাড়ির সন্নিকটে শিবির সন্নিবেশ করেন।

তুমুল লড়াই

রাজা মুসলমানদের আগমনবার্তা পেয়ে বহু সেনাসহ সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। সারাদিন তুমুল সংগ্রামের পর সন্ধ্যা সমাগমে যুদ্ধ স্থগিত রাখা হয়। প্রথম দিনের যুদ্ধে রাজার বহু সৈন্য হতাহত হয়। পরদিন পুনঃযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর রাজার সৈন্যসংখ্যা মুসলিম সৈন্যের দ্বিগুণ দেখে মুসলিম সেনাপতি চিন্তান্বিত হন। ঐ দিনের ভীষণ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে হযরত শাহ সোলায়মান (রহ.)সহ অন্যান্য বহু বুজুর্গ সৈন্য শহীদ হন।

ফুরফুরার ইতিহাস বিষয়ক নির্ভরযোগ্য প্রাচীনতম গ্রন্থ ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস-এ এই সম্পর্কিত বর্ণনা নিম্নরূপ:

প্রাতঃকালে মোসলেম সৈন্যগণ বাগ্দী রাজার অধীনস্থ গ্রামসমূহ আক্রমণ করেন। বাগদী রাজা বহু সৈন্যসহ তাঁহাদের সম্মুখীন হন। ইহার ফলে উভয় পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হয়। ইহার ফলে বাগ্দী রাজার বহু সৈন্য হতাহত হয়। পরদিবস পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কিন্তু বাগ্দী রাজার সৈন্য সংখ্যা মোসলেম সৈন্য সংখ্যার দ্বিগুণ দেখিয়া মোসলেম সৈন্যগণের মধ্যে শাহ সোলায়মান এবং অন্যান্য বহু বোজর্গ-সৈন্য শহীদ হইলেন। ইহাতে সেনাপতি বিষম চিন্তায় পতিত হইয়া অশ্রু বিসর্জ্জনপূর্ব্বক আল্লাহতায়ালার নিকট মোনাজাত করিতে লাগিলেন এবং ফতেহ হইবার নিমিত্ত দোয়া চাহিয়া নিদ্রাভিভূত হইলেন (ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস, হযরত মাওলানা আবু জাফর সিদ্দিকী সাহেবের লিখিত ও প্রকাশিত, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশকাল-আষাঢ়, ১৩৪৩ বাংলা, পৃঃ ৪-৫)।

আশ্চর্য স্বপ্ন

চিন্তিত সেনাপতি সৈয়দ হোসেন বুখারী (রহ.) নিদ্রিত অবস্থায় এক আশ্চর্য ও অভিনব স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন নিদ্রিত অবস্থায় তাঁহাকে স্বপ্নে যেন কেহ বলিতেছেন ঐ বাগ্দী রাজার বাড়ীতে জিঁয়ত কুন্ড-নামে এক পুষ্পরিণী আছে, তথায় দুষ্ট জেন প্রভৃতি বাস করে। আহত সৈন্যগণকে উহাতে নিক্ষেপ করিলে, উক্ত দুষ্ট জেনগণ উহাদের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া অসীম বলশালী করিয়া তোলে। এই নিমিত্ত উহার সৈন্যসংখ্যা হ্রাস পাইতেছে না। যদি কোনও উপায়ে উহাতে একখ- গরুর গোশত নিক্ষেপ করা যায়, তাহা হইলে উক্ত দুষ্ট জেন প্রভৃতি পলায়ন করিবে। সুতরাং উহাদের সমস্ত শক্তি বিনষ্ট হইয়া যাইবে। (ঐ)

আল্লাহর সাহায্য

উক্ত নিগুঢ়-রহস্য জানতে পেরে তিনি আল্লাহপাকের দরবারে শোকর গোজারী করতে লাগলেন এবং কি উপায়ে উক্ত কাজ সমাধা করা সম্ভব হয় সে বিষয়ে চিন্তা করতে থাকেন। এমন সময় খবর পেলেন যে, উক্ত রাজা ‘মেহমানদের’ অত্যন্ত সমাদর করেন এবং আহারাদি না করিয়ে কোনরূপেই তাঁকে বিদায় দেন না।

এর পরবর্তী ঘটনা ফুরফুরার ইতিহাস পুস্তকে এভাবে এসেছে:

এই সংবাদ প্রাপ্তে তিনি পুরোহিতের বেশ ধারণ করত জপমালা হস্তে লইলেন এবং একখ- গরুর গোশ্ত প্রচ্ছন্নভাবে লইয়া এক বৃক্ষতলে বসিয়া জপ আরম্ভ করিলেন। (কারণ হাদীসে আছে الحرب خدة) বাগ্দী রাজা উক্ত পুরোহিতের সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে দাসবৃন্দকে আদেশ করিল যে, তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করত উত্তমরূপে আহারাদি করাইয়া বিদায় দাও। দাসবৃন্দ নানা উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য লইয়া পুরোহিতের নিকট গমন করিলেন এবং আহার করিবার নিমিত্তে তাঁহাকে পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি তাহাদের প্রতি ভ্রক্ষেপও করিলেন না। দাসবৃন্দ বিফল মনোরথ হইয়া রাজার নিকট প্রত্যাবর্তন করিল। রাজা স্বয়ং তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া বিনয় পূর্বক তাঁহাকে রাজবাড়ি ভ্রমণ করিয়া আহারাদি সম্পন্ন করিতে সবিশেষ অনুরোধ করিলে, পুরোহিত বেশধারী হযরত শাহ হোসেন বোখারী (রহ.) উত্তরে জানাইলেন যে, আমি বহুদিন পর্যন্ত স্নান করি নাই এবং স্নান না করিয়া আহারাদি সম্পন্ন করিতে পারিব না। অদ্য জিঁয়ত কু- পুষ্করিণীতে স্নান করিয়া আহারাদি সম্পন্ন করিলে গোনাহ সমূহ মোচন হইবে। ইহা বিধাতার আদেশ। তন্নিমিত্ত এখানে উপস্থিত হইয়াছি।

তদ্শ্রবণে বাগদী রাজা অতিশয় আনন্দিত হইল। তাঁহাকে জিঁয়তকুন্ডে পুষ্করিণী দেখাইয়া তথায় স্নান করিতে অনুরোধ করিলেন এবং অন্দর মহলে প্রবেশ করিলেন। তিনি এই সুযোগে আপন উদ্দেশ্য পূর্ণ করিলেন। গোশতখ- পুষ্করিণীতে নিক্ষিপ্ত হইবা মাত্র এরূপ ভয়াবহ শব্দ উত্থিত হইল যে, রাজবাড়ির সমস্ত মানুষ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পতিত হইল। ইত্যবসরে তিনি ঐ স্থান হইতে প্রস্থান করত নিজ শিবিরে উপস্থিত হইলেন। উল্লিখিত শব্দটি আর কিছ্ই নহে, জিঁয়ত-কুন্ডে যে সকল দুষ্ট জেন প্রভৃতি ছিল, তাহারা ঐরূপ বিকট শব্দ করিয়া ঐ স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছিল (ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস, ৩য় সংষ্করণ, ১৩৪৩ বাংলা, পৃষ্ঠা ৫-৬)।

বাগদী রাজার পলায়ন

পরদিন সকালে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হল। উভয়পক্ষের বহু সৈন্য হতাহত হল। বাগদী রাজা আহত সৈন্যগণকে পূর্বের ন্যায় জিয়ত কুন্ডে নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ঐদিন একজন সৈন্যও ক্ষমতাসম্পন্ন হলো না, বরং পানিমগ্ন হয়ে সত্বর প্রাণত্যাগ করল। রাজা চিন্তা-ভাবনা করে কোন কুলকিনারা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে অবশেষে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর রাজার শরণাপন্ন হওয়ার উদ্দেশ্যে অবশিষ্ট সৈন্যসহ পলায়ন করলেন।

চার-সহোদরের পশ্চাদধাবন ও শাহাদাত

মুসলিম সেনাপতির আদেশে চার-সহোদর (১) হযরত শাহ সৈয়দ খায়রুর রহমান, (২) হযরত শাহ সৈয়দ তবিবর রহমান, (৩) হযরত শাহ সৈয়দ আবদুর রহমান, (৪) হযরত শাহ সৈয়দ ফয়জুর রহমান (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম) পলায়নরত রাজার সৈন্যদের পশ্চাদধাবন করেন। মুসলিম সেনাবাহিনীতে সম্ভবত অশ্বারোহী সৈন্য অতি অল্পই ছিলেন। অশ্বারোহী চারজন রাতের শেষ প্রহরে কাগমারী মাঠে শত্রুসেনার সম্মুখীন হন। বাগ্দী রাজা কাগমারি মাঠে রাত্রি যাপন করার জন্য শিবির স্থাপন করেছিলেন। এতদ্দর্শনে তাঁরা মাঠের অদূরেই একটি বৃক্ষের নীচে রাত্রিযাপন করলেন। নিশা অবসানের পূর্বে তখনও অন্যান্য মুসলিম সৈন্যগণ এসে উপস্থিত হতে পারেননি, বিধায় প্রাতঃকালেই পলায়নমান রাজসৈন্যদের সাথে উক্ত চারজনের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রাজার অগণিত সৈন্যের মুকাবিলায় তারা চারজন অসীম বিক্রমে বহু সময় ধরে যুদ্ধ করে অনেক শত্রুসেনা হত্যা করেন। অবশেষে তাঁরা শাহাদাত বরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন। রাজা বিষ্ণুপুরে পলায়ন করেন।আর অন্যান্য শহীদদের লাশ মোবারক ফুরফুরার দক্ষিণ প্রান্তে একস্থানে দাফন করা হয়। উক্ত স্থানকে গঞ্জে শোহাদা বলা হয়।

বালিয়া-বাসন্তী হল ফুরফুরা

বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে বালিয়া-বাসন্তী পরগনায় ইসলামের সাম্য ও শান্তির বিজয় নিশান উড্ডীন হয়। সে সময় হতে উক্ত বালিয়া-বাসন্তীর নাম হযরতে ফুরফুরা রাখা হয়।

ফুরফুরা নামকরণ সম্পর্কে ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস পুস্তকের বক্তব্য নিম্নরূপ:

জনাব হযরত মাওলানা শামসুল ওলামা গোলাম সালমানী (রহ.) বলেন ফুরফুরা এই শব্দ পুরফরা হইতে সমূৎপন্ন হইয়াছে। পুর অর্থ পুর্ণ আর ফরা শব্দের অর্থ আনন্দ। এই অঞ্চল মুসলমানগণ দখল করিয়া পূর্ণ আনন্দ লাভ করিয়াছিলেন বিধায় এইরূপ নামকরণ করা হইয়াছে।

কেহ কেহ বলেন ফুরফুরা আরবী ফাররে ফারাহ শব্দের অপভ্রংশ। আরবি ভাষায় ফাররে শব্দের অর্থ জাকজমক আর ফারাহ শব্দের অর্থ আনন্দ। মুসলমানগণ অতি জাকজমক ও আনন্দের সহিত এই অঞ্চল দখল করিয়াছিলেন। এইজন্যে এই স্থানের নাম ফুরফুরা রাখা হইয়াছে।

আবার কেহ কেহ বলেন ফুরফুরা এই শব্দ ফরফরা শব্দের রূপান্তর। কেননা ফরফরা অর্থ দ্রুত। অতি দ্রুত মুসলমানগণ এই দেশ দখল করিয়াছিলেন। এইজন্য এই স্থানের নাম ফুরফুরা রাখা হইয়াছে।

উক্ত ঘটনাত্রয়ের সাহায্যে আমরা এই বুঝিতে পারি যে, ফুরফুরা শব্দের রহস্য ও বিশিষ্টতা মুসলমানদেরই বিজয় গৌরব বহন করিতেছে (ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস, ৩য় সংস্করণ, ১৩৪৩ বাংলা, পৃ ৮)।

বালিয়া-বাসন্তী বিজয় সংবাদ দিল্লীর বাদশাহ অবগত হয়ে অতিশয় আনন্দিত এবং শহীদানের মৃত্যু সংবাদে যুগপৎ দুঃখিত হলেন। কেননা তাঁরা সুলতানের বিশ্বস্ত কর্মচারী ও প্রিয়পাত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারপর বাদশাহ বঙ্গদেশের নবাব (সুলতান) বাহাদুরের নিকট এই মর্মে আদেশ দেন যে, যে সকল মুসলমান বালিয়া-বাসন্তী জয় করে হযরতে ফুরফুরায় বসতি স্থাপন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে জায়গীর প্রদান করুন। বাদশাহের উক্ত আদেশে বাংলার নবাব (সুলতান) মুসলমানদেরকে জায়গীর নিষ্কর জমি এবং যৎকিঞ্চিৎ করবিশিষ্ট বহু জমি প্রদান করেন। উক্ত নিষ্কর জমি আয়মা এবং উহার মালিকগণ আয়মাদার নামে অভিহিত। অদ্যাবধি আয়মা সম্পত্তি আয়মাদারগণ বংশ পরস্পরায় ভোগদখল করে আসছেন।

বর্তমানে ফুরফুরা, বেলপাড়া, রামপাড়া, আকুনি, বাঁদপুর, সাদপুর, কুতুবপুর, সীতাপুর, গাজীপুর, সুফিজঙ্গল, মোল্লাসিমলা, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি বহু স্থানে আয়মাদারগণ বসবাস করছেন।

ফুরফুরার আয়মাদারগণের জীবনযাত্রা অন্যান্য গ্রামবাসীদের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে গেলেও তাঁদের আচার-আচরণ, পরিবেশ-রুচি, ভাষা-ভাবধারায় স্বতন্ত্র ইঙ্গিত বহন করে। তাঁদের মেহমানদারীর খেয়াল এখনও পূর্বের ন্যায় বিদ্যমান। সাধ্যানুযায়ী চেষ্টার ত্রুটি বা কৃপণতার লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না। পর্দা-পুশিদার তম্বি এখনও প্রশংসনীয়। পাক-প্রণালী সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারায়। আমীর-গরীব নির্বিশেষে আয়মাদারদের সেই পেট-কাটা দহজিল (বৈঠকখানা) এখনও অতীত দিনের সম্ভ্রান্ত বংশীয় ভাবধারার নমুনা বহন করছে। শিক্ষা-দীক্ষা, ইশায়াতে ইসলাম, পীরি-মুরীদি, মাদ্রাসা-মক্তব, খানকা, জনকল্যাণকর সংস্থা স্থাপন প্রভৃতি খেদমতী চিন্তাধারা পূর্বের ন্যায় অদ্যাবধি বিদ্যমান।

স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জীবিত আয়মাদারগণ আল্লাহভীরু গুণীজন ছিলেন। নিষ্কর সম্পত্তি ভোগদখল করার সুবাদে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনে সুশিক্ষার সুবন্দোবস্ত তখন থেকেই প্রচলিত। এমনকি অভিজ্ঞ আলিমগণ নিজেদের তত্ত্বাবধানে স্ব স্ব গৃহে দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীদের আরবি, ফার্সি ও উর্দু প্রভৃতি ভাষায় তা’লীম দিতেন। অদ্যাবধি ঐ সব শিক্ষাগারের স্মৃতি বিদ্যমান।

মাসিক দরস সভা

আরবী মাসের প্রথম সপ্তাহের সোমবার আমাদের মাসিক দারস শুরু হয় , এটি বাদ মাগরিব শুরু হয় তারপর আবার এশা শেষে শুরু করে রাত ১০ টায় শেষ হয় , আপনি চাইলে আমাদের সভায় যোগ দিতে পারেন