দারুসসালাম মাহফিলের কারগুজারী

প্রত্যেক নতুন ভোরের মতো ২৭ শে ডিসেম্বর ২০২২ ফজরটা আপাত দৃষ্টিতে ব্যতিক্রম মনে হচ্ছিল না। তাহাজ্জুদে ছাত্রদের ঘুম থেকে উঠা, হিফজ বিভাগ থেকে এই কনকনে শীতের রাতে কুরআনের সুর ভেসে আসার পাশাপাশি মেহমানদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। গত কিছুদিন থেকেই ছাত্রদের মাঝে খুশির একটা জোয়ার বয়ে যাচ্ছিল, আসছে দারুসসালাম মাহফিল ২০২২। ৬০ বছরের ধারাবাহিকতায় এটা ছিল ৬১ তম মাহফিল। দারুসসালাম মাদ্রাসার ছাত্র এবং ছাত্রীরা মাহফিল উপলক্ষ্যে আলাদাভাবে দেয়ালিকা তৈরি করেছে, আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। ২৭ তারিখ দিবাগত রাতে ছাত্ররা দেয়ালিকা দুটো মসজিদ কমপ্লেক্সের প্রবেশপথে সুন্দর করে সাজিয়েছে। এছাড়াও ফুরফুরার প্রাক্তণ ছাত্রদের পূনর্মিলনী ও ফুযালা সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রাক্তণ ছাত্রদের উদ্যোগে দরবার প্রাঙ্গণে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। ফজর বাদ যিকরের তালিমের মাধ্যমে ফুরফুরা দরবার দারুসসালামের প্রথম দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। যিকরের হালাকাহর সবক দেন সূফী আব্দুল্লাহ জাবির সাহেব। এরপর নাস্তার আয়োজন। ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের কুরআন তিলাওয়াত, হামদ নাত ও গজল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। তারবিয়াতুল মিল্লাত একাডেমীর উস্তাদবৃন্দ, উম্মুল মুমিনীন আয়িশা সিদ্দিকা রা. বালিকা মাদ্রাসার উস্তাযাবৃন্দ ও হাফেজ মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন ইদ্রিসের টিম অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতিযোগিতাটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। জোহরের জামাত মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। জোহরের পর বিষয়ভিত্তিক বয়ান করেন মাওলানা আবুল আনসার সাহেব। বয়ান পরবর্তীতে দুপুরের মেহমানদারী মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত মেহমানদের খেদমতে মাদ্রাসার ছাত্ররা সোৎসাহে অংশ নেয়। তিন দিনের এই আয়োজনে দারুসসালাম মহল্লাবাসী আন্তরিকতার সাথে মেহমানদের খাবারের বন্দোবস্ত করেন।
দুপুরের খাবারের পর মসজিদে জামিআ ফুরফুরার উস্তায ও ছাত্ররা ছোট ছোট দল ভিত্তিক দৈনিক আমল, নামাজ শিক্ষা, মাসায়েল শেখান হাতে কলমে। পাশাপাশি কুরআনের মাশক করান ক্বারী সাহেব। কুরআনের মাশক শেষ হলে আসরের জামাত মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। বাদ আসর জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত ক্বারী জামিআ ফুরফুরার উস্তায ক্বারী জহিরুল ইসলাম সাহেব ও তার শাগরিদদের মনমুগ্ধকর কুরআন পরিবেশনা সমস্ত মুসল্লিদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। সময় গড়িয়ে যায়, মাগরিবের ওয়াক্ত ছুঁই ছুঁই। মুসল্লিদের প্রাণ এখনো তিলাওয়াতে বিভোর।
মাগরিবের আজান ও জামাত অনুষ্ঠিত হয় মাহফিলের ময়দানে। বাদ মাগরিব যিকরে তালিম দেন ও নসীহত পেশ করেন, ফুরফুরার গদ্দিনশীন পীর শায়খ আব্দুল হাই মিশকাত সিদ্দিকী (হাফিজাহুল্লাহ)। শায়খের বয়ানের পর পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রাত ১১ টা অব্দি বিষয়ভিত্তিক বয়ান করেন মাওলানা আজিজুল হক, মাওলানা কামাল উদ্দিন ও মাওলানা ইমামুদ্দীন নূরী সাহেব।
বয়ান শেষে মুসল্লিরা নিজ নিজ কাফেলার সাথে মসজিদ ও মসজিদ প্রাঙ্গণে ঘুমের বন্দোবস্ত করেন। সারারাত জামিআ ফুরফুরার আসাতিজা ও ছাত্ররা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন মেহমানদের।


দ্বিতীয় দিন তাহাজ্জুদে ছাত্ররা উঠিয়ে দেন মুসল্লিদের। কান্না রোনাজারি মসজিদ কমপ্লেক্স ভারী হয় উঠে। ফজর বাদ যিকরের সবক দেন ফুরফুরার গদ্দিনশীন পীর সাহেব হুজুর। তালিমের পর মেজবানরা নাস্তার আয়োজন করেন। নাস্তা খাবার পর ৩০ মিনিট বিশ্রাম দিয়ে মেহমানরা শরীক হন গ্রুপ ভিত্তিক মুযাকারায়।
জামিআ ফুরফুরার উস্তায ও ছাত্ররা ছোট ছোট দল ভিত্তিক দৈনিক আমল, নামাজ শিক্ষা, মাসায়েল শেখান হাতে কলমে। কারও কোন জানার কমতি থাকলে সেটা সমাধান ও প্র্যাকটিকাল বুঝিয়ে দেয়া হয়। ২য় দিনটা আরো বেশি উৎসবমুখর হয়ে উঠে। জামিআ ফুরফুরার ফুযালারা এক এক করে আসতে থাকেন। ময়দানে দীর্ঘদিন পর তাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। ফুযালাদের স্মৃতিচারণায় পরিবেশটা আনন্দঘন হয়ে উঠে। ফুযালা সম্মেলনের শেষাংশে জামিআ ফুরফুরার প্রাক্তণ ছাত্র ও ফুরফুরার গদ্দিনশীন পীর সাহেব হুজুর সমাপণী বক্তব্য প্রদান করেন। ফুযালা সম্মেলন প্রতিবছর মাহফিলের শেষ দিন বৃহস্পতিবার করার জন্য প্রস্তাবনা পেশ করেন ফুযালাগণ। পাশাপাশি ফুযালাদেও দাওয়াতী ময়দানে জোড়ালো ভূমিকা রাখার জন্য আহবান জানান।
জোহরের আজানের পর বিষয়ভিত্তিক বয়ান করেন মাওলানা আলীমুজ্জামান সাহেব। হযরতের বয়ানের পর দুপুরের মেহমানদারী অনুষ্ঠিত হয়।
মসজিদে কিছু সময় কায়লুলার পর মেহমানরা ক্বারী সাহেবের সাথে আসরের আজান অব্দি কুরআনের মাশক করেন। বাদ আসর তারবিয়াতুল মিল্লাত একাডেমীর ছাত্ররা প্রদর্শনীতে অংশ নেন। মুসল্লিরা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হন।
বাদ মাগরিব ফুরফুরার গদ্দিনশীন পীর শায়খ মিশকাত সিদ্দিকী (হাফিজাহুল্লাহ) তালিম পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত বয়ান করেন। এরপর প্রায় ঘন্টাখানেক উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। উপস্থিত মুসল্লিরা শায়খকে সরাসরি প্রশ্ন লিখে পাঠান, শায়খ জবাব দেন। যুবকদের জন্য ইসলামিক কুইজের আয়োজন করা হয়েছিল। তার বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার ও প্রাইজমানি বিতরণ করা হয়। বয়ানের পর এশার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জামাতের পরে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেন ফুরফুরার মরহুম গদ্দিনশীন পীর মাওলানা আবুল আনসার সিদ্দিকী রহ. এর কনিষ্ঠ সাহেবজাদা মাওলানা আয়াতুল্লাহ সিদ্দিকী সাহেব, মাওলানা রাশেদুল ইসলাম সাহেব, মাওলানা ফজলে রাব্বী সাহেব, মাওলানা জামশিদ বিন আমির সাহেব। সর্বশেষ দরবারের মুরব্বি বায়োজ্যেষ্ঠ পীর মাওলানা মতিউল্লাহ সিদ্দিকী (হাফিজাহুল্লাহ) মুনাজাত করে দ্বিতীয় দিনের সমাপ্তি টানেন।


গভীর রাত মসজিদে বাড়ছে রোনাজারির শব্দ। এক এক করে মুসল্লিরা উঠে পড়ছেন তাহাজ্জুদে। রবের পরম সান্নিধ্যে বান্দার অন্তর হচ্ছে পরিতৃপ্ত। ফজরের পর শায়খের তালিমে যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাকীনাহ নাযিল হচ্ছিল। তালিম বাদ নাস্তা ও বিশ্রামের পর জামিআর উস্তায ও ছাত্ররা মুযাকারায় মুসল্লিদের গ্রুপ ভিত্তিক বসেন। ওযু, গোসল, ফরজ গোসল, মৌলিক হুকুম আহকাম বিষয়ে মেহমানদের প্রশিক্ষণ দেন। এরপর সকাল ১০ টা থেকে মুবাল্লিগ সম্মেলন শুরু হয়। কেন্দ্রীয় মুবাল্লিগ মাওলানা গোলাম মোস্তাফা চাঁদ সাহেবের সঞ্চালনায় দায়িত্বশীলরা কারগুজারী শোনান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ে নিজেদের প্রস্তুতির বিষয়ে কথা বলেন। শায়খ সমাপণী বক্তব্যে পাকশী মাহফিলের প্রস্তুতি ও দরবারের কার্যক্রমের বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেন। মুবাল্লিগ সম্মেলন শেষ হতে হতে জোহরের ওয়াক্ত হয়ে যায়। জোহর বাদ মাওলানা আনোয়ার হোসাইন সাহেব তাকরার পেশ করেন। তাকরার পরবর্তী মাহফিলের মাঠেই সকল মেহমানরা দুপুরের খানায় অংশ নেন। দুপুরের খানার পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত বিরতির পর আসর অব্দি কুরআনের মাশক করান জামিআর নূরানী বিভাগের ক্বারী সাহেব। বাদ আসর আল জামিআতুস সিদ্দিকীয়া দারুল উলুম ফুরফুরার নূরানী বিভাগের ছাত্ররা প্রদর্শনীতে অংশ নেন। ছাত্রদের সুনিপুন পরিবেশনা, উপস্থিত মুসল্লিদের অন্তেও দাগ কাটে।
বাদ মাগরিব ফুরফুরার গদ্দিনশীন পীর শায়খ আব্দুল হাই মিশকাত সিদ্দিকী (হাফিজাহুল্লাহ) তালিম দেন। এরপর বয়ান পেশ করেন ফুরফুরার মুরব্বি ও বয়োজ্যেষ্ঠ পীর মাওলানা আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী (হাফিজাহুল্লাহ)। কুরআন সুন্নাহর আলোকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা পেশ করেন পীরজাদা মাওলানা মুজাহিদ সিদ্দিকী সাহেব, পীরজাদা মাওলানা সাওবান সিদ্দিকী সাহেব ও পীরজাদা মাওলানা আয়াতুল্লাহ সিদ্দিকী সাহেব।
একদিকে মধ্যরাত ব্যাপী আলোচনা চলছে অন্যদিকে চলছে শেষ দিনের মেহমানদারীর কার্যক্রম। স্বেচ্ছাসেবকদের তত্ত্বাবধানে চলছে পরদিন জুমায় অংশ নেয়া মেহমানদের তবারক প্রস্তুতির আয়োজন। প্রায় অর্ধলক্ষ মুসল্লি অংশ নেবে জুমায়। মার্কাজে ইশাআতে ইসলামের দায়িত্বশীলগণ অক্লান্ত মেহনতে আয়োজনের সবদিকে পূর্ণতা আনার চেষ্টা করে চলেছেন।
ফজরের তালিমের পর চলছে তবারক প্যাকেজিংয়ের কাজ। এরমাঝে খবর এসেছে মাহফিলে অংশ নেয়া আমাদের রাজবাড়ির এক মুহিব্বিন হার্ট এ্যাটক করে ইন্তেকাল করেছেন। শোকের ছায়া নেমে আসে মাহফিল প্রাঙ্গণে। সকাল ০৮ টায় ভাইয়ের জানাজায় শরীক হয় সকলে। শায়েখে ফুরফুরা জানাজার নামাজের ইমামতি করেন।
সকাল ১০ টার পর থেকেই পর্যায়ক্রমে জুমার মুসল্লিদের আগমন শুরু হয়ে যায়। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আশেকী সাহেব নামাজের খুশু খুযুর বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। জুমার আজানের পূর্বে আল জামিআতুস সিদ্দিকীয়া দারুল উলুম ফুরফুরার ও উম্মুল মুমিনীন আয়িশা সিদ্দিকা রা. বালিকা মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীসের ফারেগীন ছাত্র ছাত্রী ও হিফজ বিভাগের হাফেজ ছাত্র ও ছাত্রীদের পাগড়ী ও বোরকা প্রদান করা হয়। জুমার আজানের পর পরই শুরু হয় সমাপণী বয়ান। পুরো ময়দান লোকে লোকারণ্য। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শরিক হচ্ছে মানুষজন। এত্ত বড় জামাত। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক লোকের জামাতে ফুরফুরার গদ্দিনশীন পীর শায়খ আব্দুল হাই মিশকাত সিদ্দিকী (হাফিজাহুল্লাহ) বয়ানে ঈমান সৃদৃঢ় করার উপর জোড় দেন, ব্যক্তিগত আমলী জিন্দেগী গড়তে উৎসাহিত করেন। পাশাপাশি নারীর মর্যাদা, বান্দার হক আদায়ের ব্যাপারে মুরিদ, মুহিব্বিন ও মুসল্লিদের প্রতি আহবান করেন। সামাজিক নৈতিকতা, শিষ্টাচার ভুলে মুসলিম উম্মাহর দূর্দশার বিষয়ে আলোকপাত করেন।
জুমার পূর্বেই আখেরী মুনাজাত সম্পন্ন হয় কান্না ও রোনাজারির মাধ্যমে। মজলুম মুসলিম উম্মাহ, দেশ, জাতির কল্যাণে দুআ করেন শায়খ।
এক মাহফিল চলে যায়। আমরা অপেক্ষায় থাকি, পরের মাহফিল কবে আসবে। আমাদের ভাইদের সাথে আমাদের মোলাকাত হবে আবার। এবছর আবারো মাহফিল চলে এসেছে। তাও একটু এগিয়ে আর ৪ দিনের পরিবর্তে ৩ দিনে । দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নভেম্বরের ২৯, ৩০ আর ১ লা ডিসেম্বর জুমা অব্দি মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। আমরা তো আপনার অপেক্ষায়, আপনি আসছেন তো।

লিখেছেন: মুহাম্মাদ হাসান সাকলাইন