পরিচয়

ফুরফুরা… হুগলী জেলার ছোট একটি গ্রামের নাম। এই নামের পেছনে লুকিয়ে আছে সোয়া সাতশ বছরের এক বিশাল ইতিহাস। পূর্বে এ অঞ্চলে অমুসলিম বসতি ছিল। মুসলমানদের আগমনের পর তাঁদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অমুসলিম জনগণ, বিশেষত নিম্নবর্ণের নির্যাতিত হিন্দুরা দলে দলে ইসলামের সাম্য ও শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে এক সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদ।
বিভিন্ন দেশ থেকে দীনের স্বার্থে হিজরত করে ফুরফুরায় এসে যে সব মুসলমান সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করেন তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বুজুর্গ ও ওলিআল্লাহ ছিলেন। হযরত নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর বংশধরগণও ছিলেন। তাঁরা স্থায়ীভাবে ফুরফুরায় বসবাস করতে থাকেন এবং দীনের প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সেই থেকে শুরু।
পরবর্তীতে ঐসব বুজুর্গের বংশধরেরা, বিশেষত হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর উত্তরসূরীরা দীন ইসলামের খেদমতে বহুমুখী কর্মসূচি নিয়ে শুধু ফুরফুরাতেই বসে থাকেননি। ফুরফুরার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছেন। এই সুদীর্ঘ সোয়া সাতশ বছরে ফুরফুরায় জন্মগ্রহণ করেন অগণিত ওলামা-মাশায়েখ ও আউলিয়ায়ে কেরাম। এঁদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। পীর আউলিয়ার পদস্পর্শে ধন্য পূণ্যভূমি ফুরফুরা ও এর পার্শ্ববর্র্তী গ্রামগুলোতে আজও দেখা যায় শত শত বুজুর্গের কবর ও এর ধ্বংসাবশেষ।

এই ফুরফুরাতেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সিদ্দিকী বংশে জন্মগ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম ও পীর, আমীরুস্ শরিয়ত, মোজাদ্দেদে জামান হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.)। তাঁর সময়কালকে ফুরফুরার স্বর্ণযুগ বলা যায়। তাঁর সময়ে ফুরফুরা বিশ্বব্যাপী হেদায়েতী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এ অঞ্চলে নতুন নতুন অনেক মাদ্রাসা, মসজিদ, খানকাহ ও অন্যান্য দীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পুরনো মাদ্রাসা, মসজিদ ও অন্যান্য দীনি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটে। দাতব্য হাসপাতাল, পোস্ট অফিস প্রতিষ্ঠা হয়। অসংখ্য ওয়াজ ও ইসালে সওয়াব মাহফিল প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়। শিক্ষিতের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। পথ হারা মানুষ পথের দিশা পায়। পুরো অঞ্চলে ইসলামী ভাবধারা ও কৃষ্টি কালচারের ব্যাপক প্রচলন ও চর্চা শুরু হয়।

মোজাদ্দেদে জামান আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) এর হেদায়েতী তৎপরতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে কোটি কোটি মানুষ হেদায়েত হয়। হাজার হাজার মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, এতিমখানা, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা হয়। তাঁর প্রায় ষাট হাজার খলিফার মাধ্যমে ফুরফুরার হক হেদায়েত পূর্বে চীন থেকে নিয়ে পশ্চিমে আফ্রিকার গহিন অরণ্য পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

মোজাদ্দেদে জামান (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর পুত্রগণ, বিশেষত তাঁর স্থলাভিষিক্ত বড় ছেলে হযরত আব্দুল হাই সিদ্দিকী (রহ.), তারপর তাঁর বড় ছেলে মোজাদ্দেদে জামান (রহ.) এর পৌত্র হযরত আবুল আনসার মোঃ আব্দুল কাহ্হার সিদ্দিকী (রহ:) এবং তারপর তাঁর বড় ছেলে ও স্থলাভিষিক্ত হযরত আবুবকর আব্দুল হাই মিশকাত সিদ্দিকী সাহেবের মাধ্যমে ফুরফুরার হক হেদায়েতী কার্যক্রম আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং আল-হামদুলিল্লাহ এখনও এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত গতিতে চলছে।

অবস্থান

ভারতের পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলা আয়তনে খুব বড় না হলেও বহু স্বনামধন্য বিদগ্ধ সুধীজনের জন্মভূমি ও কর্মময় ময়দান। ঐতিহ্যময় হুগলী জেলার জাঙ্গীপাড়া থানার অন্তর্গত ফুরফুরা একটি অতি প্রাচীন স্থান। জেলার মহকুমা শহর শ্রীরামপুর থেকে একুশ কিলোমিটার দূরে এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী মহানগরী কলকাতা হতে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ফুরফুরা অবস্থিত।

যেভাবে যাবেন

যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়নের ফলে ফুরফুরায় যাতায়াত এখন অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। কলকাতার থেকে সরাসরি ফুরফুরা পর্যন্ত বাস সার্ভিস আছে। ট্যাক্সিক্যাব রিজার্ভ করেও যাওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশ থেকে যেতে হলে ঢাকা থেকে সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত বাস সার্ভিস আছে। ঢাকা হতে কলকাতা পর্যন্ত শ্যামলি, সোহাগ, গ্রীনলাইনসহ বিভিন্ন পরিবহনের এসি ননএসি বাস রাতদিন চলাচল করে। বর্তমানে ঢাকা থেকে সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করছে।

কলকাতা থেকে শিয়াখালা হয়ে ফুরফুরা যেতে হয়। কলকাতা মনুমেন্টের নিকটস্থ বাস টার্মিনাল হতে অনেক বাস শিয়াখালা হয়ে বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। শিয়াখালা হতে ফুরফুরার দূরত্ব তিন মাইল। এ পথটুকু বাস, ট্যাকার, অটোরিক্সা বা রিক্সায় করে ফুরফুরা যেতে হয়। সময় ও খরচ কমাতে চাইলে বেনাপোল নেমে বর্ডার পার হয়ে কলকাতা না গিয়ে বনগা হয়ে বারাসাত থেকে ৮১ নং বাসে বেরাকপুরের ধূপিঘাটে নামতে হয়। তারপর নদী পার হয়ে ওপারে শ্রীরামপুর থেকে ৩১ নং বাসসহ অন্য যেকোন বাসে ফুরফুরা যাওয়া যায়। প্লেনে যেতে চাইলে দমদম এয়ারপোর্ট নেমে সরাসরি টেক্সিতে অথবা কলকাতা হয়ে বাসে ফুরফুরা যেতে হয়।